বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গবাদি পশুর গুরুত্ব

 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গবাদি পশুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য মাংস ও দুধ গবাদি পশু থেকে প্রাপ্ত হয় । এছাড়াও, গবাদি পশুর চামড়ার উপর ভিত্তি করে বহু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, যা অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে । দুধ থেকে ছানা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি তৈরি করে বহু লোক জীবিকা নির্বাহ করে। গো-মহিষের হাড় দিয়ে বোতাম এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি তৈরি হয়, যা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে যোগ করে । গোবর কৃষি উৎপাদনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । দেশের চাষাবাদ ও পরিবহনের প্রধান শক্তি হিসেবেও গো-সম্পদ এখনও অপরিহার্য । গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন এবং উন্নত জাতের পশু পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চার করা সম্ভব ।

 

এই নির্দেশিকাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গবাদি পশু পালনের বিভিন্ন দিক, যেমন – জাত নির্বাচন, সনাতন ও আধুনিক পালন পদ্ধতি, রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা, আর্থিক বিশ্লেষণ, এবং কৃষক ও খামারিদের জন্য উপলব্ধ সুযোগ ও আধুনিক প্রযুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরবে।

 

গবাদি পশু বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরাসরি অবদান রাখে। গবাদি পশুর বহুমুখী উপযোগিতা, যেমন খাদ্য (মাংস ও দুধ), শিল্প (চামড়া, হাড়), কৃষি শক্তি (হালচাষ, পরিবহন), সার (গোবর), এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, এটিকে কেবল একটি কৃষি খাত নয়, বরং একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিতে পরিণত করে। এই খাতের উন্নয়ন খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। এর ইতিবাচক প্রভাব অন্যান্য খাতকেও প্রভাবিত করে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, গোবরকে “সর্বোৎকৃষ্ট জৈব সার” হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি এটি থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন সম্ভব, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এর অবশিষ্টাংশ উৎকৃষ্ট জৈব সার হিসেবে বিক্রি করা যায় । এই প্রক্রিয়াটি একটি বর্জ্য পণ্যকে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরিত করে, যা কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে, জ্বালানি খরচ কমায় এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে, যা পরিবেশের জন্য ইতিবাচক। এটি একটি টেকসই মডেলের ইঙ্গিত দেয়, যা পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং কৃষকদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে।

 

বাংলাদেশের প্রধান গবাদি পশুর জাত পরিচিতি

 

বাংলাদেশের মতো একটি কৃষিপ্রধান দেশে গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের গরু থেকে অধিক দুধ, মাংস এবং শক্তি পাওয়া যায়, যা দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে সহায়ক খামারের উদ্দেশ্য (দুধ, মাংস বা উভয়), স্থানীয় পরিবেশ, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক জাত নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের গরু অধিক উৎপাদনশীল হলেও তাদের পরিচর্যা এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন  

 

উন্নত ও সংকর জাত (গরু)

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু উন্নত ও সংকর জাতের গরু পালন করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হলো:

 

  • হলষ্টাইন ফ্রিজিয়ান (Holstein Friesian): হল্যান্ড এদের আদি বাসস্থান। এই জাতের গাভীগুলো কালো-সাদা রঙের হয় এবং এদের দেহ বেশ বড়। দেহের পিছন এবং মধ্যাংশে ভারী, ওলান বড় এবং লম্বা ও সরু মাথা থাকে। গাভীর ওজন ৬০০-৭০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৮০০-১০০০ কেজি হয়। এরা দৈনিক ১০-১৫ লিটার দুধ উৎপাদন করে। জন্মের সময় বাছুরের ওজন ৪৫-৫০ কেজি হয় এবং বকনা ২-২.৫ বছর বয়সে গরম হয়, মোটামুটি ১৪ মাস অন্তর বাচ্চা প্রসব করে ।
  • জার্সি (Jersey): জার্সি, গুয়েনসি, এ্যালজনি ও সার্ক চ্যানেল দ্বীপসমূহ এদের আদি বাসস্থান। সুঠাম দেহের মাঝারি আকারের গরু, পিঠের শির সোজা এবং ওলান বড়। গায়ের রং হালকা লাল। গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৬৫০-৮৫০ কেজি। দৈনিক ১০-১৫ লিটার দুধ দিয়ে থাকে ।
  • হরিয়ানা (Hariana): এটি একটি ভারতীয় জাত। ষাঁড় ও গাভী অত্যন্ত বৃহদাকার। মূলত হাল চাষ ও গাড়ী টানার জন্য খুব উপযোগী, তবে দুধাল গাভী হিসেবেও পরিচিত। এদের দেহ খুব আটসাট এবং এরা ভীষণ পরিশ্রমী। অল্প আহারে প্রতিকূল অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে। গায়ের রং সাদা। দৈনিক গড়পড়তা ৮-১২ লিটার দুধ দিয়ে থাকে ।
  • লাল সিন্ধী (Red Sindhi): পাকিস্তান এদের আদি বাসস্থান। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এদের বাসস্থান। এদের গায়ের রং লাল এবং মাঝারি আকারের গরু। ষাঁড়গুলোর দেহ বেশ নাদুস নুদুস। এই জাতের গাভী খুব দুধাল এবং এরা গড়পড়তায় ৮-১০ লিটার দুধ দেয়। গাভীর ওজন ৩৫০-৪৫০ কেজি এবং ষাঁড়ের ওজন ৪০০-৫০০ কেজি। বকনা ২-৩ বছর বয়সে বাচ্চা দেবার উপযোগী হয় এবং এরপর প্রতি বার মাস অন্তর এরা বাচ্চা দিয়ে থাকে। গাভী স্বভাবের দিক থেকে শান্ত, কিন্তু ষাঁড় ততটা শান্ত নয় ।
  • শাহীওয়াল (Sahiwal): পাকিস্তান এদের আদি বাসস্থান। লাল জাতের ষাঁড় ও গাভী, এরা একটু অলস প্রকৃতির হয়। বলদ হাল চাষ ও গাড়ী টানার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই জাতের গাভীর ওজন ৪০০-৫০০ কেজি। ষাঁড় ও বলদের ওজন ৬০০-৮৫০ কেজি। দুধ দেয় গড়পড়তায় ৮-১০ কেজি ।

উন্নত জাতের গরু যেমন হলষ্টাইন ফ্রিজিয়ান ও জার্সি অধিক দুধ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন, যা দুগ্ধ খামারের জন্য আদর্শ। অন্যদিকে, হরিয়ানা, লাল সিন্ধী ও শাহীওয়াল জাতগুলো মাংস উৎপাদন এবং কৃষি কাজের জন্যও উপযোগী। এই বৈচিত্র্য কৃষকদের তাদের নির্দিষ্ট চাহিদা ও সম্পদের উপর ভিত্তি করে সেরা জাত বেছে নিতে সাহায্য করে, যা খামারের লাভজনকতা বাড়াতে পারে। জাত নির্বাচন কেবল “উন্নত” জাত কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি খামারের নির্দিষ্ট লক্ষ্য (দুধ, মাংস, বা উভয়) এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। একটি জাতের উচ্চ উৎপাদনশীলতা তার উচ্চ পরিচর্যা এবং খাদ্য চাহিদার সাথে সম্পর্কিত। তাই, কৃষকদের তাদের বিনিয়োগ ক্ষমতা এবং বাজারের চাহিদার উপর ভিত্তি করে একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ছাগলের জাত

মাংস ও দুধ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোট এবং যমুনাপারী ছাগল বেশ প্রসিদ্ধ ।

  • ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোট (Black Bengal Goat): বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যায়। এটি নাদুস নুদুস রঙের ছোট অথচ বলিষ্ঠ ছাগল। এদের গায়ের কালো লোম খুব নরম, কান খাড়া এবং দেহ খাটো। পূর্ণবয়স্ক খাসির ওজন ১৫-২০ কেজি এবং ছাগীর ওজন ১০-১৫ কেজি হয়। স্ত্রী ছাগল বছরে গড়ে ৪টি বাচ্চা দেয় এবং বছরে ২ বার বাচ্চা দেয়। এই ছাগলের মাংসের প্রতিটি পুরতে চর্বি থাকে, তাই মাংস খুব সুস্বাদু হয়। তবে, এসব ছাগলের দুধ খুব কম হয় ।
  • যমুনাপারী (Jamunapari): যমুনা ও গঙ্গা নদীর অববাহিকায় এই ছাগলের আদি নিবাস। এদের আকৃতি বেশ বড় এবং দেখতে খুব সুন্দর। এদের পা লম্বা এবং গায়ের রঙ বাদামী। এই জাতের ছাগল বছরে একবার বাচ্চা দেয়। ছাগীর ওলান বেশ বড় হয় এবং এরা প্রতিদিন ৩-৪ কেজি দুধ দেয় ।

ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোটের উচ্চ প্রজনন হার (বছরে ৪টি বাচ্চা, ২ বার বাচ্চা দেয়) এবং সুস্বাদু মাংস এটিকে ছোট আকারের খামারিদের জন্য একটি অত্যন্ত লাভজনক বিকল্প করে তোলে, বিশেষ করে যারা সীমিত পুঁজি নিয়ে শুরু করতে চান। যমুনাপারীর দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ছাগল পালনে বৈচিত্র্য যোগ করে। এই দুটি জাতের ভিন্নতা দেখায় যে ছাগল পালনেও বিভিন্ন লাভজনক মডেল সম্ভব, যা কৃষকদের তাদের স্থানীয় বাজার এবং ব্যক্তিগত পছন্দের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন করতে উৎসাহিত করে।

 

সারণি ১: বাংলাদেশের প্রধান উন্নত গরুর জাত ও বৈশিষ্ট্য

 

জাতের নামআদি বাসস্থানশারীরিক বৈশিষ্ট্যগড় ওজন (গাভী/ষাঁড়)দৈনিক দুধ উৎপাদনপ্রজনন বৈশিষ্ট্যউপযোগিতা
হলষ্টাইন ফ্রিজিয়ানহল্যান্ডকালো-সাদা, বড় দেহ, ভারী পিছন ও মধ্যাংশ, বড় ওলান, সরু মাথা৬০০-৭০০ কেজি / ৮০০-১০০০ কেজি১০-১৫ লিটারবাছুরের ওজন ৪৫-৫০ কেজি, বকনা ২-২.৫ বছরে গরম, ১৪ মাস অন্তর বাচ্চাদুধ (উচ্চ)
জার্সিজার্সি, গুয়েনসি, এ্যালজনি ও সার্ক চ্যানেল দ্বীপসমূহমাঝারি আকারের, হালকা লাল রং, সোজা পিঠ, বড় ওলান৪০০-৫০০ কেজি / ৬৫০-৮৫০ কেজি১০-১৫ লিটারদুধ (উচ্চ)
হরিয়ানাভারতবৃহদাকার, সাদা রং, আটসাট দেহ, পরিশ্রমী৮-১২ লিটারহালচাষ, গাড়ী টানা, দুধ
লাল সিন্ধীপাকিস্তান (বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ)লাল রং, মাঝারি আকারের, নাদুস নুদুস ষাঁড়৩৫০-৪৫০ কেজি / ৪০০-৫০০ কেজি৮-১০ লিটারবকনা ২-৩ বছরে বাচ্চা দেয়, ১২ মাস অন্তর বাচ্চাদুধ, মাংস
শাহীওয়ালপাকিস্তানলাল রং, অলস প্রকৃতির৪০০-৫০০ কেজি / ৬০০-৮৫০ কেজি৮-১০ কেজিহালচাষ, গাড়ী টানা, দুধ

 

গবাদি পশু পালনের পদ্ধতি ব্যবস্থাপনা

 

উন্নত জাতের পশুপালনের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্য, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং যথাসময়ে রোগ দমন অপরিহার্য ।

সনাতন পালন পদ্ধতি

সনাতন পালন পদ্ধতি মূলত স্থানীয় জাতের ভালো পশু নির্বাচন এবং তাদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে ধীরে ধীরে জাত উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। এটি একটি অত্যন্ত প্রাচীন পদ্ধতি, তবে এতে সর্বাধিক সচেতনতার প্রয়োজন । বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে কৃষকেরা সাধারণত তাঁদের নিজেদের বাড়িতে একটি লম্বা সারিতে গাভী বেঁধে পালন করে থাকেন ।

 

বৈশিষ্ট্য সীমাবদ্ধতা: এই পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এলাকা থেকে দুধাল গাভী নির্বাচন করে ভালো ষাঁড়ের সাথে মিলন ঘটিয়ে ধীরে ধীরে উন্নত জাতের ষাঁড় ও গাভী পাওয়া যায়। গাভী গরম হলেই ভালো জাতের ষাঁড় খুঁজে বের করে মিলন ঘটাতে হয় । যদিও এটি একটি সরল এবং কম খরচের পদ্ধতি, যা ছোট আকারের খামারিদের জন্য উপযোগী এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া পশুর জাত তৈরি করে , তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জাত উন্নয়নের গতি অত্যন্ত ধীর এবং কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যগুলো দ্রুত ও নিশ্চিতভাবে পাওয়া কঠিন। এতে অনেক সময় ধরে ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক নির্বাচনের প্রয়োজন হয় । এছাড়াও, বাঁধা ঘরে পশুর সহজে ঘোরাফেরার ব্যবস্থা না থাকায় ব্যায়াম হয় না এবং এতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। একই জায়গায় দিনরাত্রি বাঁধা থাকে বলে মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকে, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে ।

সনাতন পদ্ধতি যদিও কম ব্যয়বহুল এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়ক, তবে এর ধীরগতি এবং স্বাস্থ্যগত সীমাবদ্ধতা আধুনিক বাণিজ্যিক খামারের জন্য একটি বড় বাধা। এটি মূলত জীবিকা নির্বাহের জন্য উপযুক্ত, কিন্তু বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে এর কার্যকারিতা সীমিত। একটি বাণিজ্যিক খামারের লক্ষ্য থাকে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং লাভ সর্বাধিক করা, যা সনাতন পদ্ধতির মাধ্যমে অর্জন করা কঠিন। এটি একটি ট্রেড-অফ: কম ঝুঁকি ও কম খরচ বনাম কম উৎপাদন ও কম গতি।

আধুনিক পালন পদ্ধতি

আধুনিক পালন পদ্ধতি উন্নত জাতের পশুপালনের জন্য অপরিহার্য, যা স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্য, এবং বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেয়।

স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নির্মাণ ও পরিচর্যা

গবাদি পশুর বাসস্থান এমন উঁচু জমিতে হওয়া প্রয়োজন, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না এবং বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে না । বাসঘর দক্ষিণামুখী বা পূর্বমুখী হওয়া উচিত, যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারে । প্রতিটি ঘরের মেঝে উঁচু হবে এবং চারদিক ঢালু থাকবে যেন প্রস্রাব (চোনা) মেঝেতে জমে না থাকে। ঘরের মেঝে বাঁধাই করা ভালো, তবে মসৃণ করা চলবে না, কারণ মসৃণ মেঝেতে গরু পিছলে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে । ঘরের মেঝেতে কিছুটা খড়কুটা ব্যবহার করলে চোনা মিশ্রিত খড়কুটা এবং গোবরের মাধ্যমে চমৎকার খামারজাত সার তৈরি হয়, যা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি কার্যকর পদ্ধতি । গবাদি পশুর ফিডিং ট্রাফ (খাবার পাত্র) সব সময় পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে যাতে রোগজীবাণু জমতে না পারে ।

আবদ্ধ ঘরে প্রতি গাভীর জন্য গড়ে ৩৫-৪০ বর্গ ফুট (৮’x৫’) জায়গার প্রয়োজন হয়। ঘরের মেঝে থেকে চালার উচ্চতা কমপক্ষে ১০ ফুট হতে হবে। টিনের চালা বিশিষ্ট ঘর হলে টিনের চালার নিচে চাটাই ব্যবহার করতে হবে, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। গোয়াল ঘরে খাদ্য সরবরাহের জন্য ৫ ফুট প্রশস্ত রাস্তা, খাদ্য পাত্র ও পানির পাত্রের জন্য ২ ফুট এবং নালার জন্য ১ ফুট জায়গা রাখতে হবে । আধুনিক খামারে ঘর তৈরিতে বেশি খরচ না করে শুধু উপরে একটি ছাউনি দিলেই যথেষ্ট, যাতে সরাসরি রোদ, বৃষ্টি বা ঠান্ডা গরুর উপর না পড়ে। এতে চারপাশে বাতাস চলাচল করতে পারবে এবং গরু বৃষ্টিতে ভিজলেও তেমন ক্ষতি হবে না। এর ফলে তাদের শরীর পরিষ্কার থাকে, বাতাস পরিষ্কার থাকে এবং গরুর বৃদ্ধি দ্রুত হয়। মশার সমস্যা সমাধানের জন্য ঘরের চারপাশে নেট লাগানো যেতে পারে ।

সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা

গবাদি পশু থেকে কাঙ্ক্ষিত শক্তি, মাংস, দুধ ইত্যাদি পেতে হলে পশুকে সুষম খাদ্য দিতে হবে। পশু খাদ্যে শর্করা, আমিষ, স্নেহ পদার্থ, খনিজ পদার্থ, ভিটামিন এবং পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকতে হবে। এই খাদ্য উপাদানগুলো যদি প্রয়োজনের আনুপাতিক হারে থাকে তাহলেই সুষম খাদ্য তৈরি হয় । বিভিন্ন বয়সের পশুর জন্য বিভিন্ন খাদ্য প্রয়োজন। আবার শ্রম অথবা দুগ্ধ উৎপাদনের উপর নির্ভর করে খাদ্যের পরিমাণের তারতম্য হয়ে থাকে । গরুকে দৈহিক ওজনের শতকরা এক ভাগ হারে দানাদার খাদ্য ও ২ ভাগ হারে আঁশ জাতীয় খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। খাদ্য ২-৩ ভাগ করে দিন ব্যাপী সরবরাহ করা উচিত ।

 

গবাদি পশুকে পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস সরবরাহ করলে অধিক দুধ পাওয়া যায়, খাদ্য খরচ কম হয়, সুস্থ সবল বাছুর জন্ম নেয়, কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বাড়ে, সঠিক বয়সে যৌন পরিপক্কতা আসে, বাছুরের মৃত্যু হার কমে, দানাদার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা কম হয় ফলে উৎপাদন ব্যয় কমে যায়, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে যে বাছুর জন্ম নেয় তার দৈহিক ওজন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পাওয়া যায়, লাভ বেশি হয় ফলে কৃষক গাভী পালনে উৎসাহিত হয়, উন্নত জাতের একটি গাভী পালন করে ছোট একটি সংসার চালানো সম্ভব হয় ফলে দারিদ্র বিমোচন করা সম্ভব হয়, রোগ-ব্যাধি কম হয় ফলে চিকিৎসা খরচ খুবই কম হয়, ঔষধ খরচ কম হয়, এবং গাভীর মৃত্যু হার খুবই কম হওয়াতে আর্থিক ক্ষতি হয় না । ঘাস চাষের উপর নির্ভরতা বাড়ানো এবং দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরতা কমানো কেবল খাদ্য খরচ কমিয়ে লাভজনকতা বাড়ায় না, বরং পশুর স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং কৃত্রিম প্রজননের সফলতা বৃদ্ধি করে। এটি একটি টেকসই এবং অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর কৌশল।

 

স্বয়ংক্রিয় খাওয়ানো পদ্ধতি ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক তৈরির কৌশল: গরুকে তিনটি পদ্ধতিতে মিশ্রিত উন্নত খাবার দেওয়া যায়: ১) আঁশ জাতীয় খড় খাদ্যের সাথে মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে, ২) দানাদার জাতীয় খাদ্যের সাথে সরাসরিভাবে এবং ৩) ইউরিয়া মোলাসেস বুকের মাধ্যমে খড়ের সাথে মিশিয়ে ।

  • ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণ: প্রতি ১০০ কেজি খড়ের জন্য ১.৫-২.০০ কেজি ইউরিয়া সার ব্যবহার করে বায়ুরোধী বড় বাঁশের ডোল বা ইটের তৈরি হাউজে ৭-১০ দিন আবদ্ধ অবস্থায় রেখে দিতে হবে। তারপর ঐ খড় বের করে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে যেন ইউরিয়া তীব্র গন্ধ কিছুটা কমে আসে। এ খড়ের সাথে শতকরা ৪০ ভাগ হারে সাধারণ শুকনা খড় মিশিয়ে খাওয়ালে অ্যামোনিয়াজনিত কোনো বিষক্রিয়া হবার সম্ভাবনা থাকে না ।

সাইলেজ তৈরি (কাঁচা ঘাস সংরক্ষণ): ১০০ কেজি কাঁচা ঘাসের জন্য ৩-৪ কেজি চিটা গুড়, চিটা গুড়ের সমপরিমাণ পানি, শুকনা খড় ও পলিথিন কভার ব্যবহার করা হয়। পানি জমে না এমন একটি উঁচু স্থানে পলিথিন দিয়ে ঢেকে তার উপর ঘাস স্তরে স্তরে সাজিয়ে চিটাগুড় ও পানির মিশ্রণ ছিটিয়ে দিতে হবে। মাঝে মাঝে ঘাসের স্তরের উপর পা দিয়ে চাপ দিতে হবে যাতে ভিতরে বাতাস না থাকতে পারে। কিছু দিন পর ঘাসের রং বিবর্ণ হলেও তা খাওয়ানোর উপযোগী থাকে ।

 

সারণি : বিভিন্ন বয়সের কাজের পশুর সুষম খাদ্যের তালিকা

 

খাদ্যের ধরনপূর্ণ বয়স্ক কর্মী বলদ (দৈনিক)পূর্ণ বয়স্ক গাভী (দৈনিক)গর্ভবতী গাভী (দৈনিক)
কাঁচা সবুজ ঘাস৫-৭ কেজি৬-৮ কেজি৭-১০ কেজি
শুকনো খড়৫-৭ কেজি৬-৮ কেজি৭-১০ কেজি
গমের ভুসি, চালের কুঁড়া২-৩ কেজি১-১.৫ কেজি (কলাইয়ের খোসার মিশ্রণ সহ)১ কেজি
খেসারি, মাসকলাই ও ছোলার দানার মিশ্রণ১-২ কেজি১-১.৫ কেজি (ছোলা ও কলাই ভাঙা)১-১.৫ কেজি (খেসারি, ছোলা, মাসকলাই)
তিল বা তিসি বা বাদামের খৈল২৫০ গ্রাম২৫০ গ্রাম
সাধারণ লবণ১০০-১২৫ গ্রাম১০০-১২৫ গ্রাম৭৫-১০০ গ্রাম
চক পাউডার৫০ গ্রাম
বিশুদ্ধ পানিপ্রয়োজনমতোপ্রয়োজনমতোপ্রয়োজনমতো

বিশেষ দ্রষ্টব্য: পূর্ণ বয়স্ক গাভীর ক্ষেত্রে প্রতি ১ কেজি দুধের জন্য আধা কেজি অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য দিতে হবে ।

জাত উন্নয়নে সংকরায়ন পদ্ধতির প্রয়োগ ও সুবিধা

সংকরায়ন হলো কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যের গাভী ও ষাঁড় নির্বাচন করে তাদের মধ্যে মিলন ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত বাছুর পাওয়া। এই পদ্ধতি ৬-৭ জেনারেশন ধরে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বাছুর পাওয়া সম্ভব । উদাহরণস্বরূপ, যদি “ক” জাতের গাভী সুঠাম দেহের অধিকারী ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে কিন্তু দুধের পরিমাণ কম হয়, এবং “খ” জাতের ষাঁড়ের মা ভালো দুধ দেয় (অর্থাৎ অধিক দুধের জিন তার রয়েছে), তাহলে এই “ক” ও “খ” জাতের পশুর মিলনে আস্তে আস্তে দুধের পরিমাণ বাড়ানো যায়। ৬-৭ জেনারেশন পরে দুধাল বৈশিষ্ট্যগুলো সংমিশ্রিতভাবে নতুন পশুতে আসে এবং একটি উন্নত জাতের উদ্ভব ঘটে । এই পদ্ধতির সুবিধা হলো জাত উন্নয়নের গতি অনেক দ্রুত এবং একাধিক কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য একই পশুর মধ্যে আনা সম্ভব, যা উচ্চ উৎপাদনশীলতা (মাংস ও দুধ) অর্জনে সহায়ক । সংকরায়ন পদ্ধতি একটি বৈজ্ঞানিক এবং দ্রুত কার্যকর কৌশল, যা উন্নত বৈশিষ্ট্যগুলির দ্রুত সংমিশ্রণ ঘটিয়ে পশুর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। এটি সনাতন পদ্ধতির ধীরগতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে এবং বাণিজ্যিক খামারের জন্য অপরিহার্য।

উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা কৌশল

দৈনন্দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, বিজ্ঞানসম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্য সরবরাহ, সঠিক প্রজনন, এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত গাভী পালনের মৌলিক বিষয় । সুস্থ গবাদিপশুকে অসুস্থ গবাদি পশু থেকে আলাদা রাখতে হবে । খামারের জীব-নিরাপত্তা (biosecurity) নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক, যা রোগ সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে । গরুকে নিয়মিত গোসল ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে ।

গবাদি পশুর রোগ-বালাই ও তার চিকিৎসা

উন্নত জাতের গবাদি পশু অধিক উৎপাদনশীল হলেও তারা রোগবালাইয়ের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ও সুষম খাদ্যের পাশাপাশি রোগবালাইয়ের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে উন্নত জাতের গবাদি পশু পালনে সাফল্য আসে না। বিভিন্ন মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগের কারণে প্রতি বছর আমরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি । তাই, রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (যেমন টিকা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, পৃথকীকরণ) কেবল চিকিৎসার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং আর্থিক ক্ষতি রোধ করে। এটি খামারের স্থায়িত্ব এবং লাভজনকতা নিশ্চিত করার একটি পূর্বশর্ত।

প্রধান সংক্রামক রোগসমূহ

গবাদি পশুর কিছু প্রধান সংক্রামক রোগ এবং তাদের ব্যবস্থাপনা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

 

  • ক্ষুরা রোগ (Foot and Mouth Disease):
    • লক্ষণ: এই রোগটি ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয়। আক্রান্ত পশুর ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বর হয়। পশু খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয় এবং মুখ দিয়ে লালা পড়ে। পায়ের ক্ষুরে ঘা বেশি হলে চলাচল করতে পারে না। পায়ের ক্ষুরে মাছি বসে এবং ডিম পাড়ে, পরবর্তীতে কীড়া ক্ষুরে ক্ষত সৃষ্টি করে ।
    • প্রতিকার: আক্রান্ত পশুকে আলো-বাতাসযুক্ত শুষ্ক ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে হবে। পটাস-পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রিত পানি দিয়ে দিনে অন্তত ৩-৪ বার ক্ষতস্থান ও মুখ ধুয়ে দিতে হবে। সালফানিল্যামাইড পাউডার ক্ষুরের ঘায়ে লাগালে ঘা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে। ক্ষুরের গায়ে তারপিন তেল নারকেল তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে মাছি বসবে না। সালফামেজাথিন ৩৩.১/৩% সলিউশন বা ভেসাদিন ইনজেকশন দিলে রোগের উপশম হয়। পশুকে সবল রাখার জন্য নরম ভাত, ভাতের মাড়, ভেজানো খইল খেতে দেওয়া প্রয়োজন ।
    • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: সাধারণত টিকা প্রদান এবং আক্রান্ত পশুর থেকে সুস্থ পশুকে আলাদা রাখা এই রোগের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ।
  • বাদলা (Black Quarter):
    • লক্ষণ: বাদলা অত্যন্ত মারাত্মক রোগ। সকল প্রকার গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত হয়। এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটে। বাছুর গরুর এই রোগ বেশি হয়। তীব্র জ্বর (১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) হয়। পশু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। শরীরের কোনো কোনো অঙ্গ অবশ হয়ে ফুলে ওঠে। জাবর কাটা বন্ধ হয়ে যায়। পশু খুব তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে যায় ও মারা যায় ।
    • প্রতিকার: টেরামাইসিন ও পেনিসিলিন ইনজেকশন ভালো কাজ করে। সিরিঞ্জের সাহায্যে ব্ল্যাক কোয়াটার অ্যান্টিসেরাম পুশ করলে উপকার পাওয়া যায় ।
    • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: সুস্থ পশুকে প্রতিরোধক টিকা প্রদান করতে হবে। মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা অথবা ৪/৫ ফুট মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। চামড়া না ছাড়িয়ে পেট ফুটো করে দেওয়া প্রয়োজন ।
  • গো-বসন্ত (Cowpox):
    • লক্ষণ: এক প্রকার ভাইরাস দ্বারা এই রোগ ঘটে। গাভীর ওলান, বাঁটের ত্বক, ষাঁড়ের শুক্র থলির ত্বক এবং অন্যান্য নরম জায়গায় প্রথম বোঝা যায়। সর্ষের দানার মতো লাল ফোস্কা দেখা যায়। পশুর মুখের খাদ্যনালীতে ঘা হয়। পাতলা পায়খানা হয়। পশুর শ্বাসকষ্ট হয়। কয়েকদিনের মধ্যে রোগাক্রান্ত পশু মারা যায় ।
    • প্রতিকার: অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ভালো কাজ করে। ক্ষতস্থানে মলম প্রয়োগে কিছুটা উপশম হয় ।
    • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: প্রতিরোধক টিকা প্রদান। পরিচ্ছন্ন জায়গায় পশুর বসবাসের ব্যবস্থা করা। বিশুদ্ধ পানি পান করানো ।
  • গলাফোলা রোগ (Haemorrhagic Septicemia):
    • লক্ষণ: এটি একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। সকল প্রকার গবাদি পশু এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্ষা শেষে এই রোগের আক্রমণ বেশি হয়। স্যাঁতসেঁতে মাটিতে এই রোগের জীবাণু অতি দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে এবং সুযোগ পেলেই পশুকে আক্রমণ করে। অসুস্থ পশুর গলা ও গলকম্বল ফুলে যায়। অনেক সময় মাথাও ফুলে যায়। শরীরের তাপমাত্রা খুব বৃদ্ধি পায়। পাতলা পায়খানা করে। জাবর কাটা, দুধ দেওয়া ও বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানো বন্ধ হয়ে যায়। চোখ দিয়ে পানি ঝরে। পশুর মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয়। হাঁ করে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে। আক্রমণের ২৪-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পশু মারা যায় ।
    • প্রতিকার: অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ও সালফার ড্রাগ ভালো কাজ করে ।
    • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: নিয়মিত টিকা প্রদান করতে হবে। আক্রান্ত পশুকে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে আলাদা করে নিতে হবে। পশুকে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে ।

প্রাথমিক চিকিৎসা ও ভেটেরিনারি পরামর্শের গুরুত্ব

রোগ দেখার সাথে সাথে স্থানীয় ভেটেরিনারি চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। মৃত পশু সঠিক নিয়মে ধ্বংস, সৎকার বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ডিজইনফেকশন করতে হবে ।

 

সারণি : গবাদি পশুর প্রধান রোগবালাই: লক্ষণ, প্রতিকার প্রতিরোধ

 

রোগের নামধরনপ্রধান লক্ষণসমূহপ্রাথমিক প্রতিকার পদ্ধতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
ক্ষুরা রোগভাইরাস১০৫-১০৭° ফা. জ্বর, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, লালা পড়া, পায়ের ক্ষুরে ঘা, কীড়া সৃষ্টিআক্রান্ত পশুকে পৃথকীকরণ, পটাস-পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে মুখ ও ক্ষতস্থান ধোয়া, সালফানিল্যামাইড পাউডার/তারপিন তেল ব্যবহার, সালফামেজাথিন/ভেসাদিন ইনজেকশন, নরম খাদ্যটিকা প্রদান, আক্রান্ত পশুকে সুস্থ পশু থেকে আলাদা রাখা
বাদলাব্যাকটেরিয়া১০৫-১০৭° ফা. তীব্র জ্বর, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, শরীরের অঙ্গ ফুলে অবশ, জাবর কাটা বন্ধ, দ্রুত দুর্বল হয়ে মৃত্যুটেরামাইসিন ও পেনিসিলিন ইনজেকশন, ব্ল্যাক কোয়াটার অ্যান্টিসেরাম পুশসুস্থ পশুকে টিকা প্রদান, মৃতদেহ পুড়িয়ে/পুঁতে ফেলা, পেট ফুটো করা
গো-বসন্তভাইরাসগাভীর ওলান/বাঁট/ষাঁড়ের শুক্র থলিতে লাল ফোস্কা, খাদ্যনালীতে ঘা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট, মৃত্যুঅ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন, ক্ষতস্থানে মলম প্রয়োগপ্রতিরোধক টিকা প্রদান, পরিচ্ছন্ন বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি পান করানো
গলাফোলা রোগব্যাকটেরিয়াগলা ও গলকম্বল ফুলে যাওয়া, মাথা ফোলা, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পাতলা পায়খানা, জাবর কাটা বন্ধ, চোখ দিয়ে পানি ঝরা, মারাত্মক শ্বাসকষ্ট, ২৪-৩৬ ঘণ্টায় মৃত্যুঅ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন, সালফার ড্রাগনিয়মিত টিকা প্রদান, আক্রান্ত পশুকে দ্রুত পৃথকীকরণ, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি

 

গবাদি পশু পালনে খরচ ও লাভজনকতা বিশ্লেষণ

 

গবাদি পশু পালন একটি সম্ভাবনাময় খাত হলেও এর আর্থিক দিকগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

খামার স্থাপনের প্রাথমিক খরচ

একটি ছোট বা মাঝারি আকারের গরুর খামার স্থাপনের জন্য খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। মাত্র ১০ লাখ টাকা হলেই যে কেউ এমন একটি খামার শুরু করতে পারে । সাধারণত, গরুর ঘর বানানোর জন্য ২০ লাখ টাকা খরচ করা হয়, কিন্তু এটি অপ্রয়োজনীয়। গরুকে ঘরের মধ্যে রাখার পরিবর্তে, শুধুমাত্র উপরে একটি ছাউনি দিলেই যথেষ্ট, যাতে সরাসরি রোদ, বৃষ্টি বা ঠান্ডা গরুর উপর না পড়ে । এতে চারপাশে বাতাস চলাচল করতে পারবে এবং গরু বৃষ্টিতে ভিজলেও তেমন ক্ষতি হবে না, তাদের শরীর পরিষ্কার থাকবে, বাতাস পরিষ্কার থাকবে এবং গরুর বৃদ্ধি দ্রুত হবে । মশার সমস্যা সমাধানের জন্য ঘরের চারপাশে নেট লাগানো যেতে পারে ।

প্রাথমিক পর্যায়ে গরুর ঘর তৈরিতে ১ লাখ টাকার বেশি খরচ করা উচিত নয়। এর পাশাপাশি, ১ বিঘা জমিতে ঘাসের কাটিং লাগানো যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য খরচ কমাতে সাহায্য করবে । জমি কেনার প্রয়োজন না হলে, পাশের জমি দুই-তিন বছরের জন্য ভাড়া হিসেবেও নেওয়া যেতে পারে ।

দৈনিক খাদ্য, চিকিৎসা ও পরিচর্যা বাবদ চলমান খরচ

গবাদি পশুর খাদ্য খরচ একটি বড় অংশ। কাঁচা ঘাসের উপর নির্ভরতা বাড়ালে দানাদার খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা কমে, ফলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় । উন্নত জাতের গাভী পালনে প্রতিদিনের খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ প্রায় ৪৫০ টাকা হতে পারে । তবে, ঘাস চাষের মাধ্যমে এই খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব । রোগ-ব্যাধি কম হলে চিকিৎসা খরচও খুবই কম হয় ।

দুধ, মাংস ও অন্যান্য উপজাত থেকে আয়ের উৎস

গরুর খামার থেকে আয়ের প্রধান উৎস হলো দুধ ও মাংস। একজন শিক্ষিত যুবক যদি আধুনিক জ্ঞান ব্যবহার করে হাইব্রিড গরু পালন করে, তাহলে সে প্রতিদিন ১৫ থেকে ৩০ লিটার পর্যন্ত দুধ পেতে পারে । ১৫ লিটার দুধের মূল্য ৬০০ টাকা হলে, প্রতিদিনের খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ খরচ ৪৫০ টাকা বাদ দিলে প্রতিদিন ১৫০ টাকা লাভ থাকে । এভাবে ৫০টি গরুর খামার থেকে চক্রাকারে ৫০% গরু থেকে দুধ পাওয়া সম্ভব । কোরবানির ঈদে গরুর দাম অনেক বেড়ে যায়, ফলে মাংস উৎপাদনে উচ্চ মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা থাকে । দুধ ও গোবর থেকেও আয় সম্ভব ।

লাভজনকতা বিশ্লেষণ: ছোট ও মাঝারি খামারের সম্ভাব্য আয়-ব্যয় এবং মুনাফার হার

একটি ছোট বা মাঝারি আকারের খামার থেকে প্রায় ৩০ ভাগ মুনাফা অর্জন করা সম্ভব । তবে, খামারে লাখ লাখ টাকা লাভ হবে এমন ধারণা সঠিক নয়; এখানে পরিশ্রম অনেক এবং লাভ খুব সীমিত । খামার করে সাথে সাথে মজা পাওয়া যায় না, মজা পাওয়া যায় ২৪ মাস পর । লাভজনকতা নির্ভর করে গরুর প্রজাতি, পালনের পদ্ধতি, বাজার চাহিদা, এবং পরিচর্যার মানের উপর । দেশের দেশী জাতের গরুগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কম এবং প্রতিদিন প্রায় ২ থেকে ৫ লিটার দুধ দেয় । উন্নত জাতের একটি গাভী পালন করে একটি ছোট সংসার চালানো সম্ভব, যা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ

গবাদি পশুর বর্জ্য, যেমন গোবর ও গো-মূত্র, সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। গোবর কৃষি উৎপাদনের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট জৈব সার । এছাড়াও, গরুর খামারের বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব । বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, যা গ্রামীণ জনপদে জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সাহায্য করে । বায়োগ্যাস প্রকল্পে ব্যবহার শেষে গরুর বর্জ্য জৈব সারে রূপান্তরিত হয়, যা ভালো সার হিসেবে বিক্রি করা যায় । পটিয়া উপজেলায় অন্তত সাড়ে তিনশ’ গরুর খামারে বায়োগ্যাস প্রকল্প রয়েছে, যা গ্রামীণ জীবনচিত্র পাল্টে দিচ্ছে । এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খামারিরা আর্থিকভাবে লাভবান হন এবং পরিবেশের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবও কমানো সম্ভব হয় ।

 

কৃষকদের জন্য সুযোগ, সচেতনতা আধুনিক প্রযুক্তি

 

বাংলাদেশে গবাদি পশু পালনে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এই খাতকে আরও লাভজনক ও টেকসই করে তুলছে।

৬.১ সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা

  • প্রশিক্ষণ কার্যক্রম: বাংলাদেশ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পশুপালন ও তার রোগবালাইয়ের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় । প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরও খামারিদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেমন ডেইরি ফার্ম ব্যবস্থাপনা, মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং গবাদিপশু পাখী পালনে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উঠান বৈঠকের আয়োজন ।
  • কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ: গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন দেশ ও জাতির জন্য একটি উন্নয়নমূলক আধুনিক কার্যক্রম । স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের ১২৫টি গাভী ও ষাঁড় আমদানি করে সাভার কেন্দ্রীয় গো প্রজনন খামারে দেশী গাভীর সাথে ক্রসব্রিডিং করানো হয় 。 এর উৎসাহজনক ফলাফলের ভিত্তিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে দেশব্যাপী কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয় এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক ২২টি জেলায় কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয় । বর্তমানে প্রতি উপজেলাতে পশুসম্পদ উন্নয়নে সরকার একজন করে পশুচিকিৎসক নিয়োগ করেছেন, যারা কৃত্রিম প্রজননসহ নানাবিধ পশু সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন । কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত ষাঁড়ের শুক্রাণু ব্যবহার করে বছরে ২ লক্ষেরও বেশি বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব । একটি ষাঁড়ের বীজ থেকে প্রতি বছর ৬০ থেকে ৮০টি গাভীর প্রজনন করানো সম্ভব, কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ গাভী প্রজনন করানো যায় । এটি অনেকাংশে সংক্রামক ব্যাধি রোধ করে এবং গাভী ষাঁড়ের দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয় না ।
  • ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সুবিধা: কৃষি ব্যাংক দুগ্ধ গাভী প্রতি ২৫,০০০/- টাকা, হালচাষ করা গরুর জন্য ২০,০০০/- টাকা এবং মহিষের জন্য ২০,০০০/- টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে । ঋণ প্রাপ্তির জন্য আবেদনকারীকে ব্যাংকের নির্ধারিত ফরম পূরণ, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়া, এবং প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য (যেমন প্রজেক্ট প্রোফাইল, আর্থিক বিশ্লেষণ) প্রদান করতে হয় । যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরও প্রশিক্ষণার্থীদের মাসিক ভাতা প্রদান করে এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেয় ।
  • প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের লক্ষ্য কার্যক্রম: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গবাদি পশু-পাখির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিরাপদ প্রাণিজাত পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা, জেনেটিক রিসোর্স সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, এবং খামার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে কাজ করছে । তারা দুধের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে জাত উন্নয়ন, বাজার ব্যবস্থা জোরদারকরণ, মাননিয়ন্ত্রণ, এবং স্কুল ফিডিং এর মাধ্যমে দুধ পানের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ।
  • বেসরকারি সংস্থা এনজিওদের ভূমিকা: ব্র্যাক (BRAC) এর মতো বেসরকারি সংস্থা কৃত্রিম প্রজনন সেবা, কৃষক প্রশিক্ষণ, মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক, এবং টেলিহেলথ কেয়ারের মতো পরিষেবা প্রদান করে । ব্র্যাক ১৯৮৭ সাল থেকে কৃত্রিম প্রজনন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে এবং বর্তমানে নিজস্ব বুল স্টেশন থেকে হিমায়িত সিমেন উৎপাদন করে মানসম্মত কৃত্রিম প্রজনন সেবা নিশ্চিত করছে । গ্রামীণ কৃষি ফাউন্ডেশনও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মৎস্য ও কৃষি খাতে ঋণ ও ঝুঁকি মূলধন প্রদান করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান রাখছে । প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও ‘ডেইরি ভ্যালু চেইন ফোরাম’ চালু করেছে, যার লক্ষ্য ১০,০০০ দুগ্ধ খামারিকে (যার মধ্যে ৮,০০০ নারী) তাদের সাপ্লাই চেইনে একীভূত করা এবং অতিরিক্ত ৫০,০০০ খামারিকে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা ।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার

  • গবাদি পশুর বীমা পদ্ধতি: ফিনিক্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড গবাদি পশুর সুরক্ষায় ‘ক্যাটেল ইনস্যুরেন্স পলিসি’ চালু করেছে, যা খামারিদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে । এই বীমা পদ্ধতি খামারিদের জন্য ঋণ পাওয়া সহজ করে ।
  • রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (আরএফ) আইডেনটিফিকেশন ট্র্যাকিং সিস্টেম: এই সিস্টেমের মাধ্যমে বীমার আওতায় আসা গবাদিপশুর সঠিক স্বাস্থ্য, রোগ-বালাইয়ের তথ্য ও অবস্থান নির্ণয় করার সুবিধা থাকছে । এটি একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যা ইন্টারনেট অব থিংস প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল সফটওয়্যারের মাধ্যমে গরুকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করে, ফলে অসুস্থ প্রাণীর দ্রুত সুচিকিৎসাও নিশ্চিত করা সম্ভব । প্রতিটি গরুর পাকস্থলীতে একটি বায়োসেন্সর প্রবেশ করানো হয়, যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করে এবং অন্তত পাঁচ বছর কার্যকর থাকে ।
  • ডিজিটাল রেকর্ড কিপিং মোবাইল অ্যাপের ব্যবহার: আদর্শ প্রাণিসেবা’র মতো প্ল্যাটফর্ম মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে গবাদি প্রাণীর রেজিস্ট্রি ও বংশের তথ্য, গর্ভাবস্থা ও প্রজনন সম্পর্কিত তথ্য, স্বাস্থ্য, টিকা ও খামার পরিচালনা সংক্রান্ত তথ্য, খাদ্য গ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য ও ওজন পরিমাপ সংরক্ষণ করার সুবিধা প্রদান করে । এটি সময়মত গাভীর হিট নির্ণয় এবং সঠিক সময়ে বীজ ভরন সংক্রান্ত তথ্য প্রেরণ করে, পাশাপাশি এসএমএস-এর মাধ্যমে আগাম বাছুর হওয়া ও অন্যান্য সতর্কতাবার্তা প্রেরণ করে । এছাড়াও, এটি গবাদি প্রাণীর সার্বক্ষণিক শারীরিক তাপমাত্রা, সুস্থতা পর্যবেক্ষণ ও অসুস্থতা সংক্রান্ত সতর্কতাবার্তা প্রেরণ করে । প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর একটি অ্যাপের সূচনা করেছেন, যার মাধ্যমে গবাদি পশুপালকরা গরু-মহিষের প্রজনন বা গর্ভধারণ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, উপযুক্ত খাদ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কিত তথ্য পেতে পারেন ।
  • টেলিমেডিসিন সেবা: ব্র্যাকের মতো সংস্থাগুলো গবাদি পশুর স্বাস্থ্য সেবার জন্য টেলিমেডিসিন পরিষেবা প্রদান করে, যা কৃষকদের জন্য দ্রুত এবং সহজলভ্য ভেটেরিনারি পরামর্শ নিশ্চিত করে ।

সচেতনতা বৃদ্ধি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

  • সুষম খাদ্য ঘাস চাষের গুরুত্ব: কৃষকদের মধ্যে সুষম খাদ্যের গুরুত্ব এবং কাঁচা ঘাস চাষের সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাস সরবরাহ করলে খাদ্য খরচ কমে, পশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে, এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ।
  • রোগ প্রতিরোধ স্বাস্থ্যবিধিতে কৃষকদের ভূমিকা: রোগবালাই দমনে কৃষকদের নিয়মিত টিকা প্রদান, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, এবং অসুস্থ পশুকে দ্রুত পৃথক করার বিষয়ে সচেতন করা অপরিহার্য ।
  • বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিবেশগত অর্থনৈতিক গুরুত্ব: গবাদি পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধা সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করা উচিত ।
  • খামার পরিচালনায় সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ তা মোকাবিলায় করণীয়: খামার পরিচালনায় বড় বিনিয়োগ, রোগের ঝুঁকি, এবং দ্রুত লাভের অভাবের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় । এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত ব্যবস্থাপনা কৌশল, এবং সরকারি-বেসরকারি সহায়তার সদ্ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার সুপারিশমালা

 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গবাদি পশু পালন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় খাত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই খাতের অবদান অনস্বীকার্য। একটি সফল ও টেকসই গবাদি পশু খামার পরিচালনার জন্য জাত নির্বাচন, বিজ্ঞানসম্মত পালন পদ্ধতি, রোগ ব্যবস্থাপনা, এবং আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অপরিহার্য।

 

সফল টেকসই গবাদি পশু খামার পরিচালনার জন্য মূল বিষয়সমূহ:

  • সঠিক জাত নির্বাচন: খামারের উদ্দেশ্য (দুধ বা মাংস) এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নত বা সংকর জাত নির্বাচন করা লাভজনকতার প্রথম ধাপ। হলষ্টাইন ফ্রিজিয়ান ও জার্সি দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য, এবং হরিয়ানা, লাল সিন্ধী, শাহীওয়াল মাংস ও শ্রমের জন্য উপযোগী। ব্ল‍্যাক বেঙ্গল গোট মাংসের জন্য এবং যমুনাপারী দুধের জন্য ছোট খামারিদের জন্য বিশেষ উপযোগী।
  • আধুনিক বাসস্থান পরিচর্যা: উঁচু ও ঢালু মেঝেযুক্ত স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান, পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা, এবং পরিচ্ছন্ন খাবার পাত্র রোগমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করে। ামার তৈরিতে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো উচিত, শুধু ছাউনিই যথেষ্ট।
  • সুষম খাদ্য ব্যবস্থাপনা: পশুর বয়স ও উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী সুষম খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে কাঁচা ঘাস চাষ ও সাইলেজ তৈরির মাধ্যমে খাদ্য খরচ কমানো সম্ভব, যা উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে এবং পশুর স্বাস্থ্য উন্নত করে।
  • রোগ প্রতিরোধ চিকিৎসা: উন্নত জাতের পশু রোগপ্রবণ হওয়ায় নিয়মিত টিকা প্রদান, অসুস্থ পশুকে পৃথকীকরণ, এবং খামারে জীব-নিরাপত্তা কঠোরভাবে অনুসরণ করা অত্যাবশ্যক। রোগ দেখা দিলে দ্রুত ভেটেরিনারি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • আর্থিক পরিকল্পনা: খামার স্থাপনের প্রাথমিক খরচ ও চলমান খরচ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। দুধ ও মাংসের পাশাপাশি গোবর থেকে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, যা খামারের সামগ্রিক লাভজনকতা বৃদ্ধি করে।
  • প্রযুক্তি সহায়তা গ্রহণ: কৃত্রিম প্রজনন, গবাদি পশুর বীমা, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ট্র্যাকিং সিস্টেম, ডিজিটাল রেকর্ড কিপিং এবং টেলিমেডিসিন সেবার মতো আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা উচিত। সরকারি সংস্থা (যেমন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর) এবং বেসরকারি সংস্থা (যেমন ব্র্যাক, প্রাণ-আরএফএল) প্রদত্ত প্রশিক্ষণ, ঋণ সুবিধা, ও কারিগরি সহায়তা গ্রহণ করে খামারিরা নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পারেন।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং কৃষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পরামর্শ:

গবাদি পশু পালন খাতটি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আমিষের চাহিদা পূরণে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বিশাল সম্ভাবনা ধারণ করে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কৃষকদের নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে হবে:

  • প্রশিক্ষণ জ্ঞান অর্জন: আধুনিক পালন পদ্ধতি, রোগ ব্যবস্থাপনা, এবং আর্থিক পরিকল্পনা সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা।
  • প্রযুক্তির ব্যবহার: খামারের আকার ও সামর্থ্য অনুযায়ী ডিজিটাল প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, যা উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াবে।
  • টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: গোবর থেকে বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদন করে পরিবেশগত সুবিধা এবং অতিরিক্ত আর্থিক লাভ অর্জন করা।
  • সহযোগিতা নেটওয়ার্কিং: স্থানীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তর, এনজিও, এবং অন্যান্য খামারিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, যা তথ্য আদান-প্রদান ও সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।
  • বাজার বিশ্লেষণ: বাজারের চাহিদা ও প্রবণতা সম্পর্কে সচেতন থাকা, যাতে উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পাওয়া যায়।

সঠিক পরিকল্পনা, বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা, এবং আধুনিক প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের গবাদি পশু পালন খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং কৃষকদের জন্য একটি টেকসই ও লাভজনক জীবিকা নিশ্চিত করতে পারে।

 

 

 

Scroll to Top